Monday, November 8, 2010

Naouka Mallarai Awami Leaguer Pran


নৌকার মাল্লারাই আওয়ামী লীগের প্রাণ

মোনায়েম সরকার

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি রাজনৈতিক দলের ষাটতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী কম কথা নয় বিশেষ করে আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের বেলায় এটা ষাটতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী রাজনৈতিক দিক থেকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ আমরা জানি যে সেক্সপিয়ারের বিখ্যাত নাটক হ্যামলেটকে যেমন ডেনমার্কের প্রিন্স ছাড়া কল্পনাই করা যায় না, তেমনি আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির কথা চিন্তাই করা যায় না বরং আওয়ামী লীগই হলো বাংলাদেশের ঐতিহ্য এবং ভবিষ্য যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে এবং বাঙালি জাতি থাকবে, ততোদিন এই সত্যটি মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগের হাত ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পথেই বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে ভবিষ্যতেও আওয়ামী লীগ বাংলার জনগণের দল হিসেবেই টিকে থাকবে

দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক সামপ্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুকাল পরেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্ম বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং গণমানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়া দলটি দ্রুত বাংলার জনগণের দলে রূপান্তরিত হয় শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের ছয় দশকের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখলে এটা স্পষ্ট হয়ে যে গণমানুষই হলো রাজনৈতিক দলটির প্রাণ স্পষ্ট করে বলতে হয়, দেশের ৬৮ হাজার গ্রামের ত্যাগী নিবেদিত কর্মীদের কারণেই আওয়ামী লীগ বেঁচে আছে এরা কেবলই গুণ টেনেছে, কখনো নৌকায় চড়েনি জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে রাজনীতি করেছে, কিন্তু দলের কাছ থেকে কোনো ব্যক্তিগত সুযোগ নেয়নি

আজ এমন একটা সময়ে আওয়ামী লীগের ষাটতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত হচ্ছে, যখন দলটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তবে জন্মের পর থেকে আওয়ামী লীগ পর্যন্ত মাত্র ১০-১১ বছরে ক্ষমতায় থেকেছে বাকি সময় দলটিকে থাকতে হয়েছে বিরোধী দলে বা রাজপথে জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে আর সময়ে দলটিকে জেল-জুলুম-নির্যাতন আর নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হয়েছে এমন কি নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েও আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা যায়নি এর কারণ দলটির প্রকৃত শক্তি তার অগনিত কর্মী, তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত শক্তিশালী সংগঠন এবং কৃষক, শ্রমিক মেহনতি মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন যে কারণে দেখা গেছে, যখনই এদেশে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ভোট প্রদানের সুযোগ পেয়েছে, তখনই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করেছে এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি, ’৫৪, ’৭০, ’৯৬ ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে এসব নির্বাচনের ফলাফল এটাই স্পষ্ট করেছে যে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরাই আওয়ামী লীগের প্রাণশক্তি বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে এরাই হলো আওয়ামী লীগের বাল্ব, যারা দুর্দিনের অন্ধকারের মধ্যে নিঃস্বার্থভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আলোকে জ্বালিয়ে রাখে

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আওয়ামী লীগ ৬০ বছর ধরে নানা ষড়যন্ত্র এবং প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে টিকে আছে তার প্রাণশক্তির জন্য আর এই প্রাণশক্তি হলো তৃণমূলের সাধারণ কর্মী-সমর্থক গাঁ-গেরামের এই কর্মী-সমর্থকরা দল ক্ষমতায় থাকতে কোনো সুযোগ নেয়নি কিংবা ক্ষমতাকে ভাগ্য বদলের হাতিয়ার করেনি দেশপ্রেম এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শই আওয়ামী লীগের প্রতি তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে এর পাশাপাশি, ৬০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পাই যে যারা নৌকায় চড়েছে, অর্থা ক্ষমতার হালুয়া-রুটি খেয়েছে, মন্ত্রী-এমপি হয়ে বাড়ি-গাড়ি প্লট পেয়েছে, ব্যবসা-টেন্ডার নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে, তারাই কিন্তু কখনো বামে, কখনো ডানে বিচ্যুত হয়ে দলের সঙ্গে বেইমানি করেছে কিন্তু ৬০ বছরে সুযোগ বুঝে নৌকা থেকে বেরিয়ে যাওয়াদের তালিকা নেহায়েত খাটো নয় মাওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, সালাম খান, সিরাজুল আলম খান, খোন্দকার মোস্তাক, . কামাল হোসেনসহ অনেকেই বিভিন্ন সময়ে দল থেকে বেরিয়ে গেছেন তাদের কেউ গেছে ডানে, কেউ বামে তারা দল ভাঙ্গাসহ নানাভাবে আওয়ামী লীগের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে এতে আওয়ামী লীগের স্বাভাাবিক গতি সাময়িকভাবে ব্যাহত হলেও শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে বেইমানি করেছে তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যুগের সঙ্গে তাল রেখে, দেশ জনগণের প্রয়োজনে আন্দোলন-সংগ্রামে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে আজও স্বমহিমায় ভাস্বর

আওয়ামী লীগের ইতিহাস, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই-এর ইতিহাস সেটা পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের আমলেই কখনো বত্যয় ঘটেনি এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আওয়ামী লীগকে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে দলটিকে নানাভাবে ধ্বংসের চেষ্টা করেছে আর কাজে আওয়ামী লীগের দলত্যাগীরাও ব্যবহৃত হয়েছে৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন এই বাম বিচ্যুতির ফলে আওয়ামী লীগের মূলধারা ব্যাহত হয় পরের বছর, ’৫৮ সালে দেশে মার্শাল দেওয়া হয় অথচ ওই বছরেই সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল মাওলানা ভাসানী বামপন্থীদের নিয়ে আওয়ামী লীগকে তখন না ভাঙ্গলে পাকিস্তানিরা মার্শাল দেওয়ার সাহস পেত না সেবার ১০ বছর দেশে স্বৈরশাসন ছিল এই স্বৈরশাসন না থাকলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই আরো আগেই আমরা স্বাধীনতা পেতাম একইভাবে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময় ভেতর থেকে আক্রান্ত হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে দলটিকে যখনই যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তখনই ভেতর থেকে আঘাত এসেছে ষাটের দশকেও দেখা গেছে, আতাউর রহমান খান, সালাম খান, আব্দুস সামাদের মতো প্রধান নেতাদের ডান বিচ্যুতি তারা আওয়ামী লীগ ছেড়ে পিডিএমের পক্ষে অবস্থান নেয় কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতৃবৃন্দ মূলধারায় থেকে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিল সে সময় কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক এই বলে ভবিষ্য বানী করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টিকবে না, আতাউর রহমান খান, সালাম খানেরাই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে টিকে থাকবে কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তার উল্টোটাই বঙ্গবন্ধুকে সভাপতি করে এবং তাজউদ্দিন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে যে নতুন নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়েছিল, সেই আওয়ামী লীগই -দফা, ১১-দফা স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছে প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু এই পদক্ষেপের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগকে নবজন্ম দিয়েছেন আওয়ামী লীগের ৬০ বছরের ইতিহাসে এটাই বড় মাইল ফলক

স্বাধীনতা অর্জনের অব্যাহতির পর, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে বাম-বিচ্যুতি ঘটে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের শ্লোগান দিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করে তাদের এই প্রক্রিয়া আওয়ামী লীগকে দুর্বল এবং বঙ্গবন্ধুকেও অপ্রস্তুত করেছিল এর পেছনে যে আওয়ামী লীগ বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের হাত ছিল পরবর্তীকালের ঘটনাবলী থেকে সেটা স্পষ্ট হয়েছে ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এবং জেলখানায় চার জাতীয় নেতা হত্যাকাণ্ড ছিল আওয়ামী লীগের ওপর বিরাট আঘাত আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশকে নেতৃত্ব শূন্য করার এই অপপ্রয়াসের পর খোন্দকার মোশতাক কিছু বিশ্বাসঘাতককে নিয়ে ডেমোক্রেটিক লীগ গঠন করেছিল আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার জন্য সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানও ইউসুফ আলী, সোহরাব হাসান, ওবায়দুর রহমানদের দলে টেনেই ক্ষান্ত ছিলেন না, মিজানুর রহমান চৌধুরীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ভাঙ্গার কাজটিও করেন পরবর্তীকালে জিয়ার উত্তরসূরি এরশাদ সাহেবও একই কাজটি করেন আব্দুর রাজ্জাকের বাকশাল গঠনের মাধ্যমে পরবর্তীকালে ১৯৯৩ সালে বিখ্যাত আইনজীবী সংবিধান প্রণেতা . কামাল হোসেনও আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে মহা ধুমধামের গণফোরাম গঠন করেছিলেন এখন রাজনীতিতেই প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছেন তিনি আওয়ামী লীগের ইতিহাসে দেখা গেছে, দলের মূলধারার সঙ্গে বিশ্বাস-ঘাতকতা করে যারা বেরিয়ে গিয়েছিলেন তারা সুবিধা করতে পারেননি প্রায় সকলেই রাজনীতিতে হারিয়ে গেছেন, কেউ কেউ আবার মূল ধরে ফিরে এসে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন মোদ্দাকথা হলো, আওয়ামী লীগের মূলধারার বাইরে গিয়ে যারা স্বৈরাচার সহ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে আওয়ামী লীগ বিরোধী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে, তারা শেষ পর্যন্ত নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্বই ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন বেইমানির খাতায় নাম লিখিয়ে ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে এদের বিপরীতে বঙ্গবন্ধুর কথাই ধরা যাক বঙ্গবন্ধু জেল-জুলুম ত্যাগ স্বীকার করে কখনোই মূলধারার রাজনীতি থেকে নিজকে যেমন বিচ্যুত করেননি, তেমনি দলকেও মূলধারা হতে বিচ্যুত হতে দেননি কারণেই তিনি মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে এতো কিছু করতে পেরেছিলেন বাংলার গণমানুষের নেতা থেকে জাতির মনকে উন্নীত হয়েছেন

আওয়ামী লীগের ৬০ বছরের ইতিহাসে ডান বাম বিচ্যুতির ফলে নেতিবাচক প্রভাব যে একেবারে পড়েনি, তা নয় এর ফলে দেখা গেছে সামরিক বিভ্রান্তি এবং দলের ভেতরে পুরানা ত্যাগী নেতাদের জায়গায় ব্যবসায়ী-দুর্বৃত্তরা ঠাঁই নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে তবে আওয়ামী লীগের মতো বিশাল দলের অবস্থা হলো অনেকটা সমুদ্রের মতো সমুদ্রের অভ্যন্তরে হাঙ্গর-তিমি থাকে,

 তেমনি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে অপশক্তি হিসেবে কিছু সুবিধাবাদী দুর্বৃত্ত থাকাটা অস্বাভাবিক নয় তবে আওয়ামী লীগের মূল শক্তি হচ্ছে তৃণমূলের সেই সকল কর্মী-সমর্থক, যারা নৌকার মাল্লা হিসেবে আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রেখেছে এরা সাধারণ জনগণ এদের কারণেই আওয়ামী লীগ বহতা নদীর মতো কোনো বড় নেতা দল ত্যাগ করে গেলেও দলের কোনো ক্ষতি হয় না

বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসুরি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আজ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এই দলের প্রতি জনগণের আস্থা অটুট থাকার কারণ হলো জন্মলগ্ন থেকেই দলটির গণমুখী প্রগতিশীল কর্মসূচি বাস্তবায়নের ঐতিহ্য আওয়ামী লীগ কোনো ডানপন্থী কিংবা বামপন্থী দল নয় তবে ডান বামের মাঝখানে অবস্থান হলেও পুরোপুরি মধ্যপন্থী নয় একটু বামঘেঁষা দল প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির ফলে আওয়ামী লীগের পক্ষে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মূলধারার রাজনৈতিক দল হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব হয়েছে প্রগতিশীলতাই আওয়ামী লীগকে মুসলিম লীগ কিংবা বিএনপি থেকে পাথর্ক করে রেখেছে আওয়ামী লীগের -দশকের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই সত্য বেরিয়ে আসবে, বাঙালি জাতির যে রাজনৈতিক তৃষ্ণা- সেটা আওয়ামী লীগের পক্ষেই মেটানো সম্ভব কারণেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ দলটিকে ভালোবাসে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরাই দলটির প্রকৃত প্রাণ কাজেই তৃণমূলের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকেই প্রাধান্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে এগিয়ে যেতে হবে

২৩ জুন ২০০৯

No comments:

Post a Comment